রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৯ অপরাহ্ন

করদাতাদের অর্থ নয়ছয় করেছেন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা :প্যান্ডোরা পেপার্স

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২১
  • ১০ Time View

বিশ্বের রথি-মহারথীদের গোপন আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড ফাঁস নিয়ে বিশ্বব্যাপী তুলকালাম।আইসিআইজে ১৪টি ভিন্ন ভিন্ন আইনি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন গোপন নথি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। এসব নথিতে অবৈধ লেনদেন, কর ফাঁকি এবং বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের অফশোর (বিদেশে থাকা কাগজে-কলমে নামমাত্র কোম্পানি। এর কোন কার্যালয় বা কর্মী থাকে না। এসব কোম্পানির ব্যবসার নেপথ্যে কে থাকে তা জানার সুযোগ না থাকায় এখানে সহজেই অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখা যায়) আর্থিক সম্পদ নিয়ে গোপন তথ্য রয়েছে।

এছাড়া অর্থের অবৈধ চেনেলাইজেশন এবং ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ‘কালো টাকা’ পাচারে যুক্ত থাকা বিশ্বের শীর্ষ আইনি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুখোশ খুলে গিয়েছে এসব ফাঁসকৃত তথ্যের মাধ্যমে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ওয়াশংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এবং দেড় শতাধিক সংবাদ সংগঠনের দীর্ঘ কয়েকমাসের অনুসন্ধানে পাওয়া এসব গোপন নথির নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপার্স’।

আইসিআইজে জানিয়েছে, এই গোপন নথিগুলো একটি ঝলমলে ইন্ডাস্ট্রিকে সামনে নিয়ে এসেছে যারা কিনা বিশ্বের অতি ধনী, ক্ষমতাধর সরকারি কর্মকর্তা এবং অন্যান্য অভিজাতদেরকে কর কর্তৃপক্ষ, আইনজীবী এবং অন্যান্যদের থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার লুকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।

গোপন নথিগুলো ২ দশমিক ৯৪ টেরাবাইটসের মতো বিশাল বলে জানিয়েছে আইসিআইজে। অর্ধদশক আগে পানামা পেপার্স নামে ফাঁস হয়ে যাওয়া এ ধরনের আর্থিক রেকর্ডের চেয়েও এবারের ‘প্যান্ডোরা পেপার্স’ আরও শক্তিশালী।

প্যান্ডোরা পেপার্সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের নাম রয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতার কথাও সেখানে উঠে এসেছে। তারা সম্ভবত জনগণের অর্থ নয়ছয় করে নিজেদের পকেট ভর্তি করেছেন। এই নেতাদের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ঘনিষ্ঠজন এবং তারা বর্তমান সাবেক মন্ত্রীপরিষদের নেতাদের মতোই বড় বড় নামধারী।

আইসিআইজের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ বিশ্বস্তদের মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা বিভিন্ন কোম্পানি ও ট্রাস্টের মাধ্যমে গোপন সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব বড় বড় ক্ষমতাসীনদের নামও প্রকাশ করেছে আইসিআইজে। এদের মধ্যে ইমরান খানের অর্থমন্ত্রী শওকত ফায়েজ আহমেদ তারিন ও তার পরিবার, ইমরান খানের অর্থনীতি ও রাজস্ব বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টার ছেলে ওয়াকার মাসুদ খানের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন অফশোর চুক্তির মধ্যে পিটিআই ডোনার আরিফ নাকভির নামও রয়েছে; যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে জালিয়াতির মামলা রয়েছে।

প্যান্ডোরা পেপারর্সকে ঘিরে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ার পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টুইটারে লিখেন, “অভিজাতদের অসৎভাবে অর্জিত সম্পদ উন্মোচন হয়েছে তাকে স্বাগত জানাই। দুর্নীতি ও কর ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে তারা এ অর্থ জমিয়েছে এবং ‘কর স্বর্গ’ নামে পরিচিত স্থানগুলোয় পাচার করেছে।”

জাতিসংঘের মহাসচিবের প্যানেল এফএসিটিআইয়ের এক হিসাবে দেখা গিয়েছে অফশোর কর স্বর্গগুলোয় সাত ট্রিলিয়ন ডলার চুরিকৃত সম্পদ জমিয়ে রাখা হয়েছে।

তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শুধুমাত্র ঐ টুইট ছাড়া প্যান্ডোরা পেপার্সে নাম আসা নেতাদের বিরুদ্ধে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব ফাঁসের মধ্যে ইমরান খানও জড়িত রয়েছেন এমন গুজব উঠছে। এই তথ্য ফাঁসের কিছুক্ষণ আগে ইমরান খানের রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন, ইমরান খানের কোনো অফশোর প্রতিষ্ঠান নেই। তবে এখানে নাম থাকার জন্য তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের জবাবদিহি করতে হবে। তবে বিড়ম্বনার বিষয় হচ্ছে ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সকে কার্যকরভাবেই ব্যবহার করেছিলেন ইমরান খান।

পানামা পেপার্সে ফাঁস হওয়া তথ্যানুযায়ী ,তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সন্তানদের লন্ডনে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। ফাঁসকৃত এসব তথ্য সে সময় ইমরান খান তৎকালীন ক্ষমতাসীন পরিবারের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন।

এই ইস্যু নিয়ে প্রচারণা করার সময় তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দেশব্যাপী বিক্ষোভ করেন এবং স্বয়ং ইমরান খান সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বাড়ির সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি নওয়াজ শরীফের পদত্যাগ দাবি করেন। তবে যাই হোক না কেন এটি হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব যাদের আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে থাকে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পরিকল্পনা সম্পর্কে আইসিআইজে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বলেছে, দুর্নীতির চর্চার প্রশ্ন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ভারত বিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনগণের আবেগ অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করেছে এসব প্রতিষ্ঠান।

নিজেদের যুক্তির স্বপক্ষে জোর দিয়ে আইসিআইজে জানিয়েছে, দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনী এবং তাদের গোপন গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বারবার ভারত বিরোধী শত্রুতা সৃষ্টি করেছে। এমনকি তারা অনেক সময় তারা এ কাজের জন্য পাকিস্তানের পশ্চিমা মিত্রদেরও ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সেনাবাহিনী দ্বিমুখী খেলা খেলছে বলে অভিযোগ করেছে পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকরা। আফগান তালেবানদের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখার সময় তারা সামরিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও হাজার হাজার কোটি ডলার অর্থ নিয়েছে।

দুর্নীতিতে সামরিক নেতৃত্বের অংশ নেওয়ার একটি মোক্ষম উদাহারণ প্যান্ডোরা পেপার্স প্রকাশ হয়েছে। পেন্ডোরা পেপার্সে বলা হয়েছে, সাবেক সেনা প্রধান এবং সাবেক মন্ত্রী রাজা নাদির পারভেজ ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণকারী একাধিক অফশোর কোম্পানিতে শেয়ার হস্তান্তর করার জন্য নিজ প্রতিষ্ঠানকে অপব্যবহার করেছেন। সেইসঙ্গে এটি লক্ষ্য করা প্রাসঙ্গিক যে ইমরান খানের পিটিআই দলের একজন শীর্ষ নেতা এই পারভেজ এবং তিনি অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন।

আইসিআইজে একইরকমভাবে আইএসআইর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল নুসরাত নাইমের নামও রয়েছে। অবসর গ্রহণের পরপরই তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আব্বাস খাত্তাকের ছেলের (যার নিজেরও একটি অফশোর কোম্পানি রয়েছে) সঙ্গে মিলে একটি কোম্পানির নিবন্ধন করান।

ফাঁসকৃত তথ্যানুযায়ী, পাকিস্তানের সাবেক সেনা স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মেয়ে শাহনাজ সাজ্জাদ আহমেদের লন্ডনে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এ বিষয়ে আইসিআইজির পক্ষ থেকে মন্তব্য করার অনুরোধ জানানো হলেও শাহনাজ কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বলা যায় ইমরান খান দুইদিক থেকেই এখন চাপের সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি বিরোধীদলের পক্ষ থেকেও তাকে তীব্র তিরষ্কারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

প্যান্ডোরা পেপার্স প্রকাশ হওয়ার পরপরই শীর্ষস্থানীয় বিরোধী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) মহাসচিব আহসান ইকবাল গণমাধ্যমের সামনে আসেন এবং বলেন, ‘ইমরান খানের নাম প্যান্ডোরার ফাঁসকৃত তথ্যে আসার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার এ পদে থাকার আর কোনো নৈতিকতা নেই।’

পরবর্তীতে পিএমএল-এনের মুখপাত্র মারিয়াম আওরঙ্গজেব এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন এবং দাবি করেন, ‘প্যান্ডোরা পেপার্সে নাম আসা ইমরান খানের অনুগত তার সব মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের খুব দ্রুত পদত্যাগ করতে হবে।’

আরেকটি বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতারাও এর সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। দলটির নেতাদের মধ্যে অন্যতম শেরি রেহমান ইমরান খানকে তীব্র আক্রমণ করেন এবং জবাবদিহিতা দাবি করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 Jagoroni TV
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com